বাংলাদেশে জমির অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, পুষ্টিহীনতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, সর্বোপরি দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় মাশরুম একটি সম্ভাবনাময় ফসল। এদেশের আবহাওয়া মাশরুম চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী। অমিত সম্ভাবনাময় ফসল মাশরুম চাষের জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বিধায় দেশে মাশরুম উৎপাদন যতই বাড়ানো হোক না কেন তাতে কোনো ফসলেরই উৎপাদন কমার সম্ভাবনা নেই। যার মোটেই চাষের জমি নেই তিনিও বসত ঘরের পাশের অব্যবহৃত জায়গায় অনেক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করতে পারেন। এজন্য ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মাশরুমের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ মাশরুম চাষ করতে পারেন। মাশরুম এমন একটি ফসল যা ধনী, দরিদ্র সবার ঘরে সমভাবে জায়গা করে নিয়েছে। গ্রাম-গঞ্জে, শহরে এমনকি অতিমাত্রায় বিলাসিদের প্রাসাদেও মাশরুম স্থান পেয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানব জাতির কল্যাণে দুনিয়ায় অগণিত জিনিসের সৃষ্টি করেছেন। এরকম কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী ও ঔষধিগুণে ভরপুর একটি দ্রব্যের সহজ-সরল নাম মাশরুম। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন খাবার। এতে আছে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, অ্যামাইনো এসিড, অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। স্বাদ, পুষ্টি ও ঔষধিগুণের কারণে এরইমধ্যে এটি সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাশরুম চাষ আমাদের দেশের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
খাদ্যগুণে সমৃদ্ধ মাশরুম অত্যন্ত
স্বাস্থ্যপ্রদ একটি খাবার। মাশরুমের পুষ্টিমান তুলনামূলকভাবে অত্যধিক এবং
এর প্রোটিন অতি উন্নতমানের এবং মানব দেহের জন্য অতিশয় উপকারী। একটি
পরিপূর্ণ প্রোটিনের পূর্বশর্ত হলো মানব দেহের অত্যাবশ্যকীয় ৯টি অ্যাসিডের
উপস্থিতি। মাশরুমে অতীব প্রয়োজনীয় এ ৯টি অ্যামাইনো অ্যাসিড বিদ্যমান।
অন্যান্য প্রাণিজ আমিষ যেমন -মাছ, মাংস, ডিম অতি নামি-দামি খাবার হলেও এতে
চর্বি স¤পৃক্ত অবস্থায় থাকায় যা অতি মাত্রায় গ্রহণ করলে শরীরে কোলেস্টেরল
বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে, যার ফলে মেদ-ভুঁড়ির সৃষ্টি,
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ প্রভৃতি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা
বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মাশরুমের প্রোটিনে-ফ্যাট এবং
কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ অতি স্বল্প এবং কোলেস্টেরল ভাঙার
উপাদান-লোভস্ট্রাটিন, অ্যান্টাডেনিন, ইরিটাডেনিন ও নায়াসিন থাকায় শরীরের
কোলেস্টেরলস জমতে পারে না বরং মাশরুম খেলে শরীরে বহু দিনের জমানো
কোলেস্টেরল ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যায়। ১০০ গ্রাম শুকনো মাশরুমে ২৫-৩৫
গ্রাম প্রোটিন রয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা যা অতি নামি-দামি খাবার হিসেবে মাছ,
মাংস, ডিম খেয়ে থাকি তার মধ্যে ১০০ গ্রাম মাছ, মাংস ও ডিমে প্রোটিনের
পরিমাণ হলো ১৬-২২ গ্রাম , ২২-২৫ গ্রাম ও ১৩ গ্রাম মাত্র।
মানব দেহের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সৃষ্টি করাই
ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান কাজ। শরীরের চাহিদামতো প্রতিদিন ভিটামিন ও
মিনারেল খেতে না পারলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা ক্রমশ দুর্বল হয়ে
নানারূপ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হয়। প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমেই সবচেয়ে বেশি
ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান। মাশরুমে আছে প্রচুর ক্যালসিয়াম, আয়রন,
পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম। সেলেনিয়াম উপাদানটি শুধু মাছেই পাওয়া যায়। যারা
পুরোপুরি নিরামিষভোজী তারা মাশরুমের মাধ্যমে এ উপকারী উপাদানটি গ্রহণ করতে
পারেন। মাশরুমে আরও আছে এরগোথিওনেইন নামে এক ধরনের শক্তিশালী
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা মানব দেহের জন্য ঢালের মতো কাজ করে। মাশরুমে
ভিটামিন বি-১২ আছে প্রচুর পরিমাণে যা অন্য কোনো উদ্ভিজ্জ উৎসে নেই। মাশরুম
কোলেস্টেরল শূন্য। এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও খুবই সামান্য। এতে যে
এনজাইম ও ফাইবার আছে তা দেহে উপস্থিত বাকি ব্যাড কোলেস্টেরলের বসতিও উজাড়
করে দেয়।
মাশরুমে উচ্চমাত্রার আঁশ থাকে, সোডিয়ামের
পরিমাণ কম থাকে এবং প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম থাকে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
সাহায্য করে। এছাড়া মাশরুমে কোলেস্টেরল কমানোর অন্যতম উপাদান ইরিটাডেনিন,
লোভাস্টটিন, এ টাডেনিন, কিটিন এবং ভিটামিন বি, সি ও ডি থাকায় নিয়মিত
মাশরুম খেলে উচ্চ রক্তচাপও হৃদরোগ নিরাময় হয়। মাশরুমের ফাইবার বা আঁশ
পাকস্থলী দীর্ঘক্ষণ ভরা রাখতে সাহায্য করে। মাশরুম রক্তে চিনির পরিমাণ
নিয়ন্ত্রণ করে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে। উচ্চ ফ্যাট সমৃদ্ধ লাল মাংসের
পরিবর্তে মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমানো সহজ হয়। ঋঅঝঊই তে প্রকাশিত এক
গবেষণায় জানা যায়, লাল মাংসের পরিবর্তে সাদা মাশরুম গ্রহণ করলে ওজন কমে।
মাশরুমে নিয়াসিন ও রিবোফ্লাবিন থাকে যা ত্বকের জন্য উপকারী। ৮০-৯০ ভাগ পানি
থাকে যা ত্বককে নরম ও কোমল রাখে।
মাশরুমে পলিফেনল ও সেলেনিয়াম নামের
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এতে মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয়
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সালফারও থাকে। এ অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো
মারাত্মক কিছু রোগ, যেমন-স্ট্রোক, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সার থেকে
শরীরকে রক্ষা করে। এটি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শিতাকে
মাশরুম দৈনন্দিন কিছু অসুখ যেমন-কফ ও ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করে। সূর্যের আলোর
সংস্পর্শে যে মাশরুম উৎপন্ন হয় তাতে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে, যা
ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের শোষণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ক্যান্সার ও টিউমার
প্রতিরোধে মাশরুম বেশ উপকারী। নিয়মিত মাশরুম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও
প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। মাশরুমের ফাইটোকেমিক্যাল
টিউমারের বৃদ্ধিতে বাঁধার সৃষ্টি করে।
মাশরুমের ভিটামিন বি স্নায়ুর জন্য উপকারী এবং
বয়সজনিত রোগ যেমন- আলঝেইমার্স রোগ থেকে রক্ষা করে। মাশরুম গ্রহণ করলে
রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মাশরুমে এনজাইম ও প্রাকৃতিক ইনসুলিন
থাকে যা চিনিকে ভাঙতে পারে। এতে থাকা ফাইবার ও এনজাইম হজমে সহায়তা করে। এটি
অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কাজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং কোলনের পুষ্টি
উপাদান শোষণকেও বাড়তে সাহায্য করে। মাশরুমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে
ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন-ডি আছে। শিশুদের দাঁত ও হাড় গঠনে এ
উপাদানগুলো অত্যন্ত কার্যকরী। মাশরুমে নিউক্লিক এসিড ও অ্যান্টি এলার্জেন
থাকায় এবং সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকায় কিডনি রোগ ও এলার্জি রোগের প্রতিরোধক।
মাশরুমে স্ফিংগলিপিড এবং ভিটামিন-১২ বেশি থাকায় স্নায়ুতন্ত্র ও স্পাইনাল
কর্ড সুস্থ রাখে। তাই মাশরুম খেলে হাইপার টেনশন দূর হয় এবং মেরুদ- দৃঢ়
থাকে। হেপাটাইটিস বি ও জন্ডিস প্রতিরোধ করে। অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা
থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মাশরুমের খনিজ লবণ দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
ড. আখতার জাহান কাঁকন*
*উপজেলা কৃষি অফিসার (এল.আর), খামারবাড়ি, ঢাকা, সংযুক্ত : মাশরুম বিশেষজ্ঞ, মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সাভার, ঢাকা
উত্তর সমূহ